স্কুলের একজন শিক্ষিকা, রূপে-গুণে সবদিক থেকে অতুলনীয়। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিয়ের নাম-গন্ধও তার মুখে নেই। সবাই অনেক বলে কয়েও কিছু করতে পারেনি। হাজার সাধাসাধিতেও তার বরফ গলাতে পারেনি। সবাই বুঝতে পারে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। একদিন সহকর্মীরা সবাই ধরে বসল, “আজ আর ছাড়াছাড়ি নেই, বলতেই হবে কেন তুমি বিয়ে করছ না। তুমি তো কোনো দিক দিয়েই ফেলনা নও। বিয়ে করে স্বামী-সংসার যারা করছে, তাদের চেয়ে তুমি কম কীসে? তাদের অনেকে তো এমন আছে যারা তোমার নখের যুগ্যিও নয়।”
“তোমরা এত করে যখন বলছ তাহলে একটা গল্প বলছি শোনো, একজন মহিলার পাঁচ কন্যাসন্তান জন্ম নিলো। তার স্বামী বিরক্ত। পঞ্চম কন্যা ভূমিষ্ট হওয়ার পর হুমকি দিয়ে রেখেছে, “এবার যদি কন্যা হয়, গলা টিপে না হয় অন্যভাবে হলেও নবজাতককে মেরে ফেলব।” আল্লাহর ইচ্ছা! এবারও কন্যাসন্তান ভূমিষ্ট হলো। বাবা সদ্যজাত কন্যাকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রাতের গভীরে চৌরাস্তার মোড়ে রেখে এলো। ফজরের পরে দেখতে গেল। গিয়ে দেখল মেয়ে শান্তভাবে ঘুমুচ্ছে। পরদিন আবার রেখে এলো, আজও একই কাণ্ড হলো। পরপর এক সপ্তাহ এভাবে করে চলল, অবস্থার কোনো হের-ফের হলো না। দুঃখিনী মা এই সাতটা রাত কুরআন তেলাওয়াত করেই বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দিলো।
আল্লাহর দরবারে ধর্না দিয়ে পড়ে রইল। দয়ালু রব মায়ের কথা ফেলে দেননি, তিনি কখনও ফেলে দেনও না। আমরা বান্দারাই যা ভুল বুঝি। সাত দিনেও মেয়েটার কিছু না হওয়াতে বাবা তার পাশবিক কার্যক্রমের ইতি টানল। কিছুদিন পর মা আবার গর্ভবতী হলো। মায়ের মনে ভয়, এবার কন্যা হলে বুঝি তার নিজেরও নিস্তার নেই। পুরো দশটা মাস ভয়ে ভয়ে কাটল। সে ধরেই নিলো তার আবার কন্যা হবে। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার জানে পানি এলো। যাক, এত দিনে আল্লাহ তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। বাবার খুশি আর ধরে না। কিন্তু মায়ের হিসেবে গরমিল হয়ে গেল। ছেলেটা হওয়ার পরদিনই বড় মেয়েটা মারা গেল। দু বছর না ঘুরতেই আরেকটা ছেলে দিলেন আল্লাহ। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, তার পরদিন আরেকটা মেয়ে মারা গেল। এভাবে একে একে আল্লাহ তাদেরকে পাঁচটা পুত্র দিলেন। সাথে সাথে পাঁচটা কন্যাকে তার কাছে উঠিয়ে নিলেন। মা এই শোক সামলাতে পারল না। পঞ্চম মেয়ে মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে মা-ও না ফেরার দেশে চলে গেল।
একমাত্র বেঁচে থাকা মেয়েটাই নবজাতক ভাইকে কোলেপিঠে করে মানুষ করে তুলল। অন্য ভাইদের আদর আব্দার মেটালো। আমার প্রিয় সহকর্মীরা! তোমরা কি বুঝতে পারছ, সেই মেয়েটা কে? যাকে আতুরঘরে বাবা মেরে ফেলতে চেয়েছিল? সে মেয়েটা হলাম আমি। আমি বিয়ে করিনি। কারণ আমার গুণধর পাঁচ ভাই বিয়ে করে যে যার সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। পিতার কোনো খোঁজ-খবরও নেয় না। মাসে ছ মাসে ইচ্ছে হলে এক-আধপাক এসে ঘুরে যায়। কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার চলে যায়। বৃদ্ধ পিতা ঘরে একা। অচল। তাকে একা রেখে অন্যকিছু ভাবা তো সম্ভব নয়। আব্বু সারাক্ষণ চোখের পানি ফেলে আর অনুশোচনা করে। বারবার তার কৃতকর্মের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চায়।”
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার তিনটি কন্যাসন্তান থাকবে এবং সে তাদের কষ্ট-যাতনায় ধৈর্য ধরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুহাম্মদ ইবন ইউনূসের বর্ণনায় এ হাদীসে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে এসেছে) একব্যক্তি প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসুল, যদি দু’জন হয়? উত্তরে তিনি বললেন, দু’জন হলেও। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, যদি একজন হয় হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, একজন হলেও। ’ (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১১)