জুয়েল ফরাজী, কুয়াকাটা
মৃত্যু যে কতটা কাছে সেদিন দেখেছিলাম গত ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর , বাবা, মা, স্ত্রী বোন ও বন্ধু বান্ধবের শত নিষেধ উপেক্ষা করে ঢাকায় গিয়েছিলাম অধিকার আদায়ের জন্য। চোখের কিছুটা উপরে গুলি খেয়ে রক্তাক্ত শরীরে চিকিৎসা নিতে পারিনি বলে কেঁদে দিলেন পটুয়াখালী জেলার মহিপুর থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী বেলাল হোসেন গালিব।
মহিপুর থেকে বাইকযোগে ৩৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা পৌঁছালাম ছোট ভাইয়ের বাসায়। ২৮শে অক্টোবর ২০২৩ সকাল ১১টায় পল্টনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, পথে পথে পুলিশের তল্লাশি, চেক পোস্ট, আ.লীগ, ছাত্রলীগের সকল বাধা উপেক্ষা করে মাঠে পৌছালাম দুপুর ২টা নাগাত। হঠাৎ চারিদিক থেকে বিকট আওয়াজ। সবার বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়ে গেছে। কেন এত গোলাগুলি। কেন এত আক্রমণ। তবুও এগিয়ে গেলাম, দেখলাম রাজপথ পুরো রণক্ষেত্র। অনেকেই রুখে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অনেকেই ভয়ে পালাচ্ছে।
আমরা পটুয়াখালী জেলার মহিপুর থানার এবং আলীপুরের কিছু কর্মী একসঙ্গে ছিলাম, তাদের সাথে আলাপ করলাম, যে আসছি যুদ্ধে, পিছুপা হলে চলবে না, এভাবে হেরে যাওয়া যায়না! হয়ত বাচবো, নয়ত রাজপথে শহীদ হব, ইতিহাস সৃষ্টি করব, চলো সবাই। আমার সাথে সবাই এক মত হলো, শুরু হলো পুলিশের সাথে কিছুক্ষণ আক্রমণ পালটা আক্রমণ, এভাবে ২-৩ মিনিটের মাথায় হঠাৎ টের পেলাম ঠিক চোখের কিছুটা উপরে যথেষ্ট ভারী এবং প্রচন্ড গতিসম্পন্ন কিছু একটা পরেছে, মুহুর্তের মধ্যে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল! চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা! টের পাচ্ছিলাম রক্তে আমার সমস্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে,পানির কলেও এত পানি ঝড়ে না যতটা রক্ত ঝড়ছিল। আমি মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। পাশে আমার সহকর্মীদের খুজছিলাম, চোখে দেখতে না পেয়ে অন্ধের মত হাতাচ্ছি আর তাদের নাম ধরে ডাকছিলাম। কেউ নেই! কাউকে না পেয়ে শরীরের ব্যাথার চেয়েও হৃদয়ে বেশি ব্যাথা পেয়েছিলাম। চোখে আমার কলিজার টুকরা ১১ মাসের রাজকন্যার ছবিটা ভেসে উঠলো, মা বাবা এবং সবার নিষেধের কথা স্মরণ হলো। ভাবলাম আমার মৃত্যুটা রাজপথে হবে বলেই সবার বাধা উপেক্ষা করে ঢাকা এসেছি অধিকার আদায়ের জন্য। মুখে দোয়া দরুদ পড়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কালেমায় তাইয়্যেবা এবং কালেমায় শাহাদাত পাঠ করার কথা অব্দি মনে আছে। শুনছিলাম কেউ বলছে এই উঠ উঠ উঠ! নাহয় আবার মেরে দিব, উঠ উঠ উঠ। এরপর আর কিছু মনে নেই!
মোটামুটি ৪৫ মিনিটের মাথায় জ্ঞান আসার পর দেখি আমি কেন্দ্রীয় নেতা হাসান মামুন ভাইয়ের বাসার গেটের সামনে। ২-৩ জন মানুষ আমার সামনে, কাউকে চিনিনা। তারা কেন্দ্রীয় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। বুঝতে পারলাম আল্লাহ নিজেই তাদেরকে পাঠিয়েছেন আমাকে উদ্ধারের জন্য। শুনলাম আমি অজ্ঞানের পর সবাই ভেবেছে আমি মারা গেছি, তাই পুলিশ আমাকে লাত্থি মেরে ট্রাকের নীচে ঢুকিয়ে দিয়েছে। পরবর্তীতে এত গোলাগুলিতেও ভয় না পেয়ে এলিয়েনের মত আমাকে উদ্ধার করেছেন এই মহা মানুষগুলো। চির কৃতজ্ঞ আমি তাদের প্রতি। প্রচুর ভয় এবং আতঙ্কে তাৎক্ষণিক অঝরে কান্না করে দিয়েছিলাম, ভাবলাম বুঝি চিরদিনের জন্য বোধহয় অন্ধ হয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর টের পেলাম ফোন বাজতেছে, তুলে দেখি আম্মুর ফোন, ২০-২৫ বার কল দিয়েছিল মায়েরা এমন কেন? সন্তানের বিপদ হলেই মায়েরা বুঝতে পারে ফোন তুলে শুনলাম আম্মুর কান্না, বাবা তোর কি হইছে ফোন ধরোনা কেন বলেই কান্না, অনেক কষ্টে এত তীব্র ব্যাথাকেও কন্ট্রল করে বলার চেষ্টা আম্মু আমি ঠিক আছি, একটু বমি আসতেছে তাই রিক্সায় করে মেডিকেলে যাচ্ছি, আমি আর ওখানে নেই, চিন্তা করিয়েন না। বমির কথা শুনে আম্মু কান্না আরো বাড়িয়ে দিল, বললো তোর সাথে কে আছে তার কাছে দে ফোনটা। তাদের নিষেধ করার পরও তারা আম্মুকে বলে দিল ওর কপালে পুলিশ গুলি করছে,তবে ও সুস্থ আছে চিন্তা করিয়েন না, আমরা ওরে আগার গাঁও বিজ্ঞান চক্ষু ইন্সটিটিউটে নিয়ে যাচ্ছি,পরিচিত কাউকে পাঠান। এরপর আমার প্রাণ প্রিয় নেতা এবিএম মোশাররফ হোসেন ভাইকে ফোন দিলাম, তাদেরকে ট্রাকিং করে এরেস্ট করতেছে তাই তার ফোন সুইচ অফ। এরপরে আমার মহিপুর সেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক প্রিয় ভাই ফরিদ খাঁন এবং কলাপাড়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ সভাপতি কে,এম সাজেদুল ইসলাম সাজু ভাইকে ফোন দিয়ে জানাতে বললাম, সঙ্গীরা জানালো। ছোট ভাই রুহুল আমিন রিয়াদ, এবং বড় ভাই ইব্রাহীম মিয়া কে ফোন দেয়া হল,মুহুর্তের মধ্যে তাদের ব্যাবসা বন্ধ করে ছুটে এলো ভাইয়ের বিপদে। এরপর হাসপাতালে যেতে না যেতে অনেকেই হাজির। ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করে দেখে চোখ ঠিক আছে। আলহামদুলিল্লাহ ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বললো, নিয়ে গেল। এরপর আমার সেজো বোন খবর শুনে পাগলের মত ছুটে এক কাপড়ে চলে গেল আমার কাছে। আমার চিন্তাটা অনেক কমে গেল। সাংবাদিকেরা যে যেভাবে পারছে নিউজ করছে, বিএনপির মিডিয়া সেল নিউজ করলো, পুরো ভাইরাল নিউজ। পরবর্তীতে প্রিয় নেতাকে জানানো হলো, সে আমলে নিলো ব্যাপারটা, আলহামদুলিল্লাহ আস্তে আস্তে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে গেলাম। এরপর এলাকায় নানান জনের নানা কথা শুনতে হলো, কিভাবে এলাকায় ঢুকবো? আওয়ামিলীগ এর বিভিন্ন পর্যায়ের গুন্ডাদের পর্যায়ক্রমে হুমকি ধামকি। এলাকার লোকজনের নানা ধরনের কথা শুনতে হলো, নিজের আপন লোকদের থেকেও নানা কথা শুনতে হলো যেমন আমি সামান্য একজন মানুষ কিভাবে ভাবলাম হাসিনাকে পতন করাতে পারব!
হাসিনা চির অমর, তার পতন সম্ভবই নয়, তাকে ঠেকানোর কেউ নেই, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর কেউ নেই এ দেশে, সেই সেরা! আমি সেদিনও বলেছিলাম এই হাসিনার যথেষ্ট অপমানজনকভাবে পতন হবে। কিভাবে হবে তা জানিনা,তবে বিশ্বাস এবং আল্লাহর উপরে ভরসা ছিল।
ঠিকই যেভাবেই হোক হাসিনার যথেষ্ট লজ্জাজনকভাবে পতন হলো এবং বাংলাদেশ পুনরায় স্বৈরাচার মুক্ত হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো৷।